{الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا. قَيِّمًا لِيُنْذِرَ بَأْسًا شَدِيدًا مِنْ لَدُنْهُ وَيُبَشِّرَ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا حَسَنًا. مَاكِثِينَ فِيهِ أَبَدًا}(الكهف: ١- ٣)
وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ أَجْمَعِيْنَ وَسَلَّمَ تَسْلِيْماً كَثِيْراً، أَمَّا بَعْدُ :
মুআয্যাজ হাযেরীন! আজ আমরা এমন এক বিষয়ে আলোচনা করব যা আমাদের কল্যাণের জামিনদার। যা আমাদেরকে রক্ষা করে যাবতীয় ফিতনা থেকে। এতে আছে অতীত-ভবিষ্যতের সংবাদ আর বর্তমানের জীবন-নির্দেশনা। এটি কোনো হেলাখেলার বিষয় নয় চূড়ান্ত ও অলঙ্ঘনীয় বিধান। ঔদ্ধত্য দেখিয়ে যে একে পরিহার করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ধ্বংস করে দেবেন। যে এ ছাড়া অন্য কোথাও জীবনের পাথেয় খুঁজবে আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করবেন। এটি আল্লাহর সুদৃঢ রজ্জু। আল্লাহ তা‘আলার প্রজ্ঞাময় আলোচনা। এটি সরল পথ। এটি থাকলে প্রবৃত্তি মানুষকে সুপথহারা করতে পারে না। এর শব্দোচ্চারণে কারও কষ্ট অনুভূত হয় না। আলিমরা কখনো এর তিলাওয়াত থেকে পরিতুষ্ট হন না। এটি পুরাতন হলেও বাতিল হয় না। এর বিস্ময় ও অলৌকিত্ব কখনো ফুরায় না। যে এ থেকে বলে সে সত্যবাদী। যে এর নির্দেশনা মতো চলে সে প্রতিদান প্রাপ্ত হয়। যে একে দিয়ে বিচার করে সে ইনসাফ করে। যে এর দিকে আহ্বান জানায় সে সুপথের দিকেই ডাকে।
সম্মানিত মুসল্লীবৃন্দ! হ্যা, আমি বলছি পবিত্র কুরআনের কথা। আল্লাহ তাআলার মহা প্রজ্ঞাময় বাণীর কথা। আমাদের কর্তব্য এ কুরআন শিক্ষা করা, নিয়মিত এর তিলাওয়াত করা, কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা। আমাদের দায়িত্ব নিজ সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দেয়া এবং তাদেরকে এর তিলাওয়াত ও ভালোবাসায় অভ্যস্ত বানানো। যাতে এর সাথে তাদের হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তারা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়। এতে করে তাদের চরিত্র হবে পবিত্র ও অপঙ্কিল। তাদের অন্তর হবে পরিশুদ্ধ। তারা হবে কুরআনের ধারক ও বাহক।
মুহতারাম হাযেরীন! আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করুন এবং কুরআনের প্রতি গুরুত্ব দিন। আল্লাহ তা‘আলা কালামে মাজীদে ইরশাদ করেন:
{ إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً يَرْجُونَ تِجَارَةً لَنْ تَبُورَ. لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدَهُمْ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّهُ غَفُورٌ شَكُورٌ }
‘ নিশ্চয় যারা আল্লাহর কিতাব অধ্যয়ন করে, সালাত কায়েম করে এবং আল্লাহ যে রিযক দিয়েছেন তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসার আশা করতে পারে যা কখনো ধ্বংস হবে না। যাতে তিনি তাদেরকে তাদের পূর্ণ প্রতিফল দান করেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে আরো বাড়িয়ে দেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল, মহাগুণগ্রাহী’ (ফাতির : ২৯-৩০)।
আল্লাহ তা‘আলা আরও ইরশাদ করেন:
{ وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا }
‘আর স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কুরআন আবৃত্তি কর’ (সূরা আল-মুযামমিল : ৪)।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র ইরশাদ করেন:
{ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ أُمَّةٌ قَائِمَةٌ يَتْلُونَ آيَاتِ اللَّهِ آنَاءَ اللَّيْلِ وَهُمْ يَسْجُدُونَ }
‘ আহলে কিতাবের মধ্যে একদল ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তারা রাতের বেলায় আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তারা সিজদা করে।’ (আলে ইমরান : ১১৩)
উসমান বিন আফফান রাযি. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
{ خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ }
‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি সর্বোত্তম যে কুরআন শেখে এবং (অপরকে) শেখায়’ (বুখারী)।
আয়িশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
(الَّذِيْ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَهُوَ مَاهِرٌ بِهِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ، وَالَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَهُوَ يَتَتَعْتَعُ فِيْهِ وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ، لَهُ أَجْرَانِ )
‘ যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে, এ অবস্থায় যে সে অভিজ্ঞ, তবে সে সম্মানিত ফেরেশতাদের সঙ্গ পাবে। আর যে ব্যক্তি তোতলাতে তোতলাতে সক্লেশে কুরআন তিলাওয়াত করবে তার জন্য দ্বিগুণ নেকী লেখা হবে’ (বুখারী ও মুসলিম)।
আবু উমামা বাহেলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন :
(اقْرَأوْا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِيَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيْعاً لُأَصْحَابِهِ )
‘তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো। কেননা তা কিয়ামতের দিন তিলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশকারীরূপে আবির্ভুত হবে’ (মুসলিম)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেন :
( وَيَجِيْءُ الْقُرْآنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيَقُوْل: يَا رَبِّ حُلِّهِ، فَيُلْبَسُ تَاجَ الْكَرَامَةِ، ثُمَّ يَقُوْلُ: يَارَبّ زِدْهُ، فَيُلْبَسُ حُلَّةَ الْكَرَامَةِ، ثُمَّ يَقُوْلُ: يَارَبِّ ارْضَ عَنْهُ فَيَرْضَى عَنْهُ، فَيَقُوْلُ إِقْرَأْ وَارْقَ، وَيُزَادُ بِكُلِّ آَيَةٍ حَسَنَةً)
‘ কিয়ামতের দিন কুরআন আবির্ভুত হয়ে বলবে, হে রব, (তিলাওয়াতকারীকে) আপনি সুসজ্জিত করুন। তখন তাকে সম্মানের মুকুট পরানো হবে। তারপর বলবে, হে রব, আপনি আরও বৃদ্ধি করুন। তখন তাকে সম্মানের পোশাক পরানো হবে। অতপর বলবে, হে রব, আপনি তার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়ে যান। তখন আল্লাহ তা‘আলা তার ওপর রাজি হয়ে যাবেন এবং বলবেন, তুমি পড় এবং ওপরে ওঠো। এভাবে প্রত্যেক আয়াতের বিনিময়ে ছাওয়াব দেয়া হবে’ (তিরমিযী)।
এই হলো কুরআন তিলাওয়াতের কিছু ফযীলত এবং তিলাওয়াতকারীর নেকীর কিছু বিবরণ। আর কুরআন তিলাওয়াত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম অসিয়ত। আবু সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসিয়ত করে বলেন, ‘আমি তোমাকে আল্লাহ-ভীতির উপদেশ দিচ্ছি, কারণ তা প্রত্যেক বস্তুর মূল। তোমার জন্য জিহাদে অংশ নেয়াও আবশ্যক, কারণ তা ইসলামের বৈরাগ্য। তোমার জন্য আরও জরুরী আল্লাহ তা‘আলার যিকর ও কুরআন তিলাওয়াত করা, কারণ তা আসমানে তোমার রূহ এবং জমিনে তোমার আলোচনা’ (মুসনাদে আহমদ, আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)।
কুরআন তিলাওয়াতের আদব
মুহতারাম হাযেরীন! কুরআন কিন্তু যেনতেন কোনো গ্রন্থ নয়। এটি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। অতএব এটাকে আমরা অন্য দশটি বইয়ের মতো পড়তে পারি না। এটি পাঠ করার আগে-পিছে কিছু আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। অন্যথায় তা আমাদের জন্য নেকীর পরিবর্তে পাপই বয়ে আনবে। কুরআন পড়তে গিয়ে তাই বেশ কিছু আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। চলুন এবার আমরা সেসব আদব সম্পর্কে জেনে নেই।
প্রথম আদব : নিয়ত শুদ্ধ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোক দ্বারা আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হবে বলে জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন হলো ক্বারী, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি নয় বরং লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে কুরআন তিলাওয়াত করত।
দ্বিতীয় আদব : পবিত্র হয়ে অযু অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা। অযু ছাড়াও মুখস্থ কুরআন পড়া যাবে কিন্তু তা অযু অবস্থায় পড়ার সমান হতে পারে না।
তৃতীয় আদব : তিলাওয়াতের আগে মিসওয়াক করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মুখগুলো কুরআনের পথ। তাই মিসওয়াক দ্বারা তা সুরভিত করো’।
চতুর্থ আদব : তিলাওয়াতের শুরুতে আউযুবিল্লাহ পড়া। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
{ فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ }
‘ সুতরাং যখন তুমি কুরআন পড়বে তখন আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান হতে পানাহ চাও’ (সূরা আন-নাহল : ৯৮)।
কতিপয় বিজ্ঞ আলিম বলেন, এ আয়াতের দাবী অনুযায়ী কুরআন তিলাওয়াতের সূচনায় ‘তাআউয়ুয’ (আউযুবিল্লাহ) পড়া ওয়াজিব। অবশ্য আলিমদের সর্বসম্মত মত হলো এটি মুস্তাহাব।
পঞ্চম আদব : বিসমিল্লাহ পড়া। তিলাওয়াতকারীর উচিত সূরা তাওবা ছাড়া সকল সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে তিনি এক সূরা শেষ করে বিসমিল্লাহ বলে আরেক সূরা শুরু করতেন। কেবল সূরা আনফাল শেষ করে তাওবা শুরু করার সময় বিসমিল্লাহ পড়তেন না।
ষষ্ঠ আদব : তারতীলের সঙ্গে কুরআন পড়া। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, তোমরা তারতীলের সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াত কর’ (সূরা আল-মুযাম্মিল : ৪)।
উম্মে সালমা রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিলাওয়াতের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, তিনি স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে পড়তেন।
আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তাঁকে একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিলাওয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি বলেন, তিনি টেনে টেনে (মদসহ) পড়তেন। এরপর তিনি পড়ে শোনান, بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ এখানে তিনি الله শব্দ টেনে পড়েন। অর্থাৎ দুই হরকত পরিমাণ স্বাভাবিক টান। الرَّحْمَنِ শব্দ টেনে পড়েন এবং الرَّحِيْمِ শব্দ টেনে পড়েন’ (বুখারী)।
সপ্তম আদব : সুন্দর কণ্ঠে কুরআন পড়া। বারা’ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শুনেছি, তিনি এশার নামাজে সূরা তীন পড়েছেন। আমি তার চেয়ে সুন্দর কণ্ঠে আর কাউকে তিলাওয়াত করতে শুনিনি’। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা নিজ কণ্ঠ দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্য দান করো। কারণ সুরেলা কণ্ঠ কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে’।
অষ্টম আদব : সুরারোপ করে কুরআন তিলাওয়াত করা। এটি সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াতেরই অংশবিশেষ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সে আমার উম্মত নয় যে সুরসহযোগে কুরআন পড়ে না’।
নবম আদব : উচ্চারণে জোর দিয়ে পড়া। অর্থাৎ তিলাওয়াতকারী পুরুষ হলে মেয়েদের মতো কণ্ঠ মোলায়েম করে পড়বে না। তদ্রুপ তিলাওয়াতকারী নারী হলে পুরুষের মতো করে উচ্চস্বরে পড়বে না। প্রত্যেকে নিজেদের স্বাভাবিক স্বরে কুরআন পড়বে।
দশম আদব : আয়াত শেষে ওয়াকফ করা। কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো, আয়াতের সমাপ্তিস্থলে ওয়াকফ করা। যদিও তা অর্থগত দিক থেকে পরবর্তী আয়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘তিনি এক আয়াত এক আয়াত করে কেটে কেটে পড়তেন। الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ বলে ওয়াকফ করতেন। তারপর الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ বলে ওয়াকফ করতেন। এভাবে তিনি তিলাওয়াত করতেন।
একাদশ আদব : একজন আরেকজনের ওপর গলা চড়িয়ে তিলাওয়াত না করা। কারণ এভাবে স্বর উচ্চ করার দ্বারা অন্যকে কষ্ট দেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মনে রেখো, তোমরা সবাই আপন রবের সঙ্গে সঙ্গোপনে কথা বলছ। অতএব একে অপরকে কষ্ট দেবে না। একজন অপরের ওপর গলা চড়িয়ে তিলাওয়াত করবে না।’
দ্বাদশ আদব : তন্ত্রা এলে তিলাওয়াত থেকে বিরত থাকা। আবূ হুরায়রা রাযি.
থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ রাতে নামাজ পড়ে, ফলে তার জিহ্বায় কুরআন এমনভাবে জড়িয়ে আসে যে সে কী পড়ছে তা টের না পায়, তাহলে সে যেন শুয়ে পড়ে’ (মুসলিম ও আহমদ)।
অর্থাৎ তার উচিত এমতাবস্থায় নামাজ না পড়ে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। যাতে তার মুখে কুরআন ও অন্য কোনো শব্দের মিশ্রণ না ঘটে এবং কুরআনের আয়াত এলোমেলো হয়ে না যায়।
ত্রয়োদশ আদব : ফযীলতপূর্ণ সূরাগুলো ভালোভাবে শিক্ষা করা এবং সেগুলো বেশি বেশি তিলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ কি রাত্রিকালে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াতে অক্ষম? কেউ যদি রাতে
{ قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ }(সূরা ইখলাস)
পড়ে তাহলে সে যেন কুরআনের এক তৃতীয়াংশ পড়লো’।
অপর এক হাদীসে রয়েছে, তিনি বলেন, ‘তোমরা (লোকজনকে) জড়ো করো। আমি তোমাদের সামনে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করবো’। অতঃপর তিনি তাঁদের সামনে সূরা (ইখলাস) পড়লেন।
যেসব সূরা ও আয়াত সম্পর্কে অধিক ফযীলত ও বেশি নেকীর কথা বর্ণিত হয়েছে এবং যেগুলো ভালোভাবে শেখা ও বেশি বেশি পড়া দরকার তার মধ্যে রয়েছে, শুক্রবার ফজর নামাজে সূরা আলিফ-লাম-আস সিজদাহ পড়া, ঘুমানোর আগে সূরা মুলক এবং ফরজ নামাজের পর সূরা নাস, সূরা ফালাক ও আয়াতুল কুরসী পড়া।
চতুর্দশ আদব : রুকূ ও সিজদায় তিলাওয়াত না করা। সহীহ হাদীসে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
পঞ্চদশ আদব :
যে ব্যক্তি অনায়াসে কুরআন পড়তে পাড়ে না তার জন্য ধৈর্য্য ধারণ করা। কেননা ‘যে ব্যক্তি তোতলাতে তোতলাতে সক্লেশে কুরআন তিলাওয়াত করবে তার জন্য দ্বিগুণ নেকি লেখা হবে’ (বুখারী ও মুসলিম)।
بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآن الْعَظِيْمِ وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْر الحْكِيْمِ, أقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ فَاسْتَغْفِرُوهُ إِنَّهُ هُو الْغَفُور الرَّحِيْمْ .
اَلْحَمْدُ لِلَّهِ عَظِيْمِ الْإِحْسَانِ، وَاسِعِ الْفَضْلِ وَالْجُوْدِ وَالْامْتِنَانِ، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمداً عَبْدُهُ وَرَسْولُهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ أَجْمَعِيْنَ وَسَلَّمَ تَسْلِيْماً كَثِيْراً، أمَّا بَعْدُ :
আমার প্রিয় ভাইয়েরা! কুরআন তিলাওয়াতের আদব নিয়ে কথা বলছিলাম।
ষষ্ঠদশ আদব : কুরআন তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো, তিলাওয়াতের সময় ক্রন্দন করা। আল্লাহ তা‘আলা তিলাওয়াতের সময় ক্রন্দনরতদের প্রশংসা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে :
{ وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا }
‘ আর তারা কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’ (সূরা বনী ইসরাঈল : ১০৯)।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘আমাকে তুমি তিলাওয়াত করে শুনাও’। বললাম, ‘আমি আপনাকে তিলাওয়াত শোনাব, অথচ আপনার ওপরই এটি অবতীর্ণ হয়েছে’? তিনি বললেন, ‘আমি অন্যের তিলাওয়াত শুনতে পছন্দ করি’। অতঃপর আমি তাঁকে সূরা নিসা পড়ে শুনাতে লাগলাম। যখন আমি
( فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيدًا )
অতএব কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং তোমাকে উপস্থিত করব তাদের ওপর সাক্ষীরূপে?)-এ পৌঁছলাম, তিনি বললেন, থামো। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাঁর চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্র“ প্রবাহিত হচ্ছে’ (বুখারী)।
উমর ইবন খাত্তাব রা. একদিন সূরা ইউসুফ তিলাওয়াত করছিলেন। যখন তিনি নিচের আয়াতে পৌঁছেন, তাঁর দুইগণ্ড বেয়ে অশ্র“রধারা বইতে শুরু করে। আয়াতটি ছিলো
{ إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللهِ وَأَعْلَمُ مِنَ اللهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ }
‘আমি আল্লাহর কাছেই আমার দুঃখ বেদনার অভিযোগ জানাচ্ছি। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানি, তোমরা তা জান না’ (ইউসুফ : ৮৬)।
কাসিম একদা আয়িশা রা.-এর কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি দেখেন আয়িশা রাযি. নিচের আয়াতটি বারবার তিলাওয়াত করছেন আর কেঁদে কেঁদে দু‘আ করছেন। আয়াতটি হলো
{ فَمَنَّ اللَّهُ عَلَيْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُومِ }
‘অতঃপর আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করেছেন এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন’ (সূরা আত-তূর : ২৭)।
সপ্তদশ আদব : কুরআন তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো এর মর্ম নিয়ে চিন্তা করা। সাধারণভাবে বলতে গেলে এটিই আসলে তিলাওয়াতের সবচে গুরুত্বপূর্ণ আদব। তিলাওয়াতের সময় চিন্তা-গবেষণা করাই এর প্রকৃত সুফল বয়ে আনে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
{ كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آَيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ }
‘ আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে’ (সোয়াদ : ২৯)।
অতএব কুরআন থেকে সে-ই উপকৃত হতে পারবে যে আল্লাহ তা‘আলার মহান বাণী নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করবে। আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্ব ও মহিমার কথা মনের পর্দায় জাগ্রত করবে। কুরআন তাকে কী বলছে তা বুঝার চেষ্টা করবে। এবং এ কথা মনে রাখবে যে সে এটি বুঝার জন্য এবং তদনুযায়ী আমল করার জন্য তিলাওয়াত করছে। তাই কেউ যদি মুখে কুরআন পড়ে আর মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও, তবে সে তিলাওয়াতের কাক্সিক্ষত লাভ অর্জন করতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
{ أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآَنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا }
‘ তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে’? (মুহাম্মদ : ২৪)
হুযাইফা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একরাতে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে নামাজ পড়লাম। তিনি বাকারা শুরু করলেন। আমি মনে মনে বললাম তিনি একশত আয়াত পড়ে রুকূ করবেন। অবশ্য তিনি পড়েই চললেন। মনে মনে বললাম তিনি দুইশত আয়াত পড়ে রুকূ করবেন। কিন্তু তিনি পড়েই চললেন। মনে মনে বললাম তিনি হয়তো এ সূরা দিয়েই একরাত পড়বেন। এরপরও তিনি পড়েই চললেন। (বাকারা শেষ করে) নিসা শুরু করলেন। নিসা পড়ে তিনি আলে-ইমরান শুরু করে শেষ করলেন। তিনি মন্থর গতিতে পড়ছিলেন। তাসবীহ সংবলিত কোনো আয়াত পড়লে তাসবীহ পড়েন। প্রার্থনা সংবলিত কোনো আয়াত পড়লে প্রার্থনা করেন। শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা সংবলিত কোনো আয়াত পড়লে শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। তারপর তিনি রুকূতে যান’ (নাসাঈ)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে খারেজী সম্প্রদায় সম্পর্কে জানিয়েছেন, তারা কুরআন তিলাওয়াত করবে কিন্তু তা তাদের গলা অতিক্রম করবে না। তিনি ইরশাদ করেন, ‘তিন দিনের কম সময়ে যে কুরআন খতম করবে, সে কুরআন বুঝবে না’।
যায়েদ বিন সাবেতকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, সাত দিনে কুরআন খতম করাটাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন? তিনি বললেন, এটা ভালো। অবশ্য আমি এটাকে পনের দিনে বা বিশ দিনে খতম করাই পছন্দ করি। কেননা আমি এর স্থানে স্থানে থেমে চিন্তা করি’ (মুয়াত্তা মালেক)।
কুরআন নিয়ে চিন্তা করতে হবে আমলের জন্য। আবূ আবদুর রহমান রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেসব সাহাবী রাযি. আমাদের কুরআন পড়িয়েছেন তারা বলেছেন, তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দশ আয়াত শিখতেন। তারপর অন্য দশ আয়াত ততক্ষণ শিখতেন না যতক্ষণ তাঁরা এ আয়াতগুলোয় কী এলেম আছে আর কী আমল আছে, তা না জানতেন। তাঁরা বলেন, সুতরাং আমরা এলেম শিখেছি এবং আমল শিখেছি।
অষ্টদশ আদব : সরব ও নীরবের মাঝামাঝি স্বরে কুরআন তিলাওয়াত করা। সরবে কুরআন তিলাওয়াত সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘আল্লাহ তা‘আলা কোনো নবীকে এতটুকু সুর দিয়ে পড়ার অনুমতি দেননি যতোটা দিয়েছেন সুরারোপ করে প্রকাশ্য কন্ঠে কুরআন তিলাওয়াতের বেলায়’। অনুরূপ তিনি ইরশাদ করেছেন: ‘সরবে কুরআন তিলাওয়াত প্রকাশ্য সাদকার ন্যায় এবং নীরবে কুরআন তিলাওয়াত গোপনে সাদকার ন্যায়’।
সুপ্রিয় হাযেরীন : প্রথম হাদীসে সরবে আর দ্বিতীয় হাদীসে নীরবে পড়ার ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। আমরা তাহলে কীভাবে সিদ্ধান্তে আসবো? হ্যা, উভয় হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে ইমাম নববী রহ. বলেন, যেখানে রিয়া, ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম ভাঙ্গানো বা নামাজরত ব্যক্তি কষ্ট পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সেক্ষেত্রে নীরবে পড়া উত্তম। এছাড়া অন্য সময় সরবে পড়া উত্তম। কারণ, এতে স্বর উঁচু করা, কষ্ট ও চেষ্টা ব্যয় করার অতিরিক্ত শ্রম দিতে হয়। তদুপরি সরবে তিলাওয়াত পাঠকের হৃদয়কে জাগ্রত করে। তার চিন্তাকে কুরআনের প্রতি নিবিষ্ট ও কর্ণকে এর দিকে সজাগ করে। এর ফলে পাঠক বেশি লাভবান হয়।
ঊনবিংশ আদব : তিলাওয়াতের সময় সিজদার আয়াত এলে সিজদা দেয়া।
বিংশ আদব : যথাসম্ভব আদবসহ বসা। বসা, দাঁড়ানো, চলমান ও হেলান দেয়া সর্বাবস্থায় তিলাওয়াত করার অনুমতি রয়েছে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন :
{ الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ }
‘যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়িয়ে, বসে ও কাত হয়ে এবং আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে’ (আলে-ইমরান : ১৯১)।
তবে বিনয়ের সঙ্গে বসে পড়া হেলান দিয়ে পড়ার চেয়ে উত্তম। জায়েযের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কোনোটাতেই সমস্যা নেই। কিন্তু উত্তমের কথা বিবেচনা করলে বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে বসে পড়াই শ্রেয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজর নামাজের পর কিবলামুখী হয়ে চারজানু হয়ে বসে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার যিকর করতেন।
একবিংশ আদব : কুরআন তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো তিন দিনের কম সময়ে খতম না করা।
কেননা যেমন আগেই উল্লেখ করেছি যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তিন দিনের কম সময়ে যে কুরআন খতম করবে, সে কুরআন বুঝবে না’ (আবূ দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)।
কুরআন সম্পর্কে উদাসীনতা ও এর ভয়াবহ পরিণাম
মুহতারাম হাযেরীন! অধিকাংশ মানুষই আজ কুরআন শিক্ষা থেকে উদাসীন। বড়রা ব্যস্ত দুনিয়া আর দুনিয়াদারি নিয়ে। ছোটরা ব্যস্ত স্কুলের রুটিন নিয়ে, যেখানে কুরআন শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয় না, যথাযথ যতœও নেয়া হয় না। শিক্ষকরাও তাদের প্রতি কাম্য দায়িত্ব পালন করেন না। আর তাদের অবশিষ্ট সময় অপচয় হয় রাস্তা-ঘাটে খেলাধুলার পেছনে। ফলে তারা কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞ হয়ে বেড়ে উঠছে। তাই দেখা যায় বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে বড় হচ্ছে অথচ শুদ্ধভাবে আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াতও পড়তে পারে না। এজন্যই দেখা যায় গ্রামাঞ্চলের অনেক মসজিদেই এখনো শুদ্ধ তিলাওয়াত করতে পারে এমন ইমাম পাওয়া যায় না। আর এসবের পিছনে প্রধান কারণ সন্তানদের কুরআন শিক্ষার ব্যাপারে পিতাদের অবহেলা। তারা জানেন না তাদের সন্তান কুরআন পড়তে পারে কি-না। এমনি আজ অধিকাংশ মুসলমানই কুরআনকে ছেড়েই দিয়েছে। দেখুন আল্লাহর নবী এদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার কাছে কীভাবে অভিযোগ করছেন
{ وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآَنَ مَهْجُورًا }
‘ আর রাসূল বলবে, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে।’ (ফুরকান : ৩০)
ইবন কাসির রহ. বলেন, কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করা, কুরআন বুঝতে চেষ্টা না করাও কুরআন পরিত্যাগ করার মধ্যে গণ্য। কুরআনের আমল ছেড়ে দেয়া, এর নির্দেশ পালন না করা এবং নিষেধ উপেক্ষা করাও তা পরিত্যাগ করার মধ্যে গণ্য। এবং কুরআন ছেড়ে অন্য কথা-কাব্যে, অনর্থক বাক্যালাপ ও গান-বাজনায় ডুবে থাকাও পরিত্যাগ করার মধ্যে গণ্য।
ভালো ক্বারীর কাছে গিয়ে কুরআন শিখতে হবে
সম্মানিত মুসল্লীয়ান! আমাদের সবার জন্য জরুরী, এমন শিক্ষকের কাছে পবিত্র কুরআন শিক্ষা করা যিনি বিশুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে জানেন। অতএব যিনি নিজে কুরআন শিখবেন বা আপন সন্তানাদিকে শেখাবেন তার কর্তব্য হলো একজন ভালো ক্বারী সাহেবের শরণাপন্ন হওয়া। যাতে বিশুদ্ধভাবে এবং সুন্দর পদ্ধতিতে কুরআন শেখা যায়। মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র কালাম সবচে’ বেশি গুরুত্ব ও যতেœর দাবিদার। ইদানীং অনেককেই দেখা যায় আরবী পড়ান। অথচ তিনি নিজেও শুদ্ধভাবে আরবী পড়তে জানেন না। মহিলাদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। যদি বাংলা-ইংরেজি শেখার জন্য ভালো মাস্টারের দরকার হয়, তাহলে আল্লাহর কিতাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখার জন্য তো আরও ভালো ওস্তাদের প্রয়োজন। দুনিয়ার শিক্ষার বেলায় গুরুত্ব দিই অথচ আখিরাতের শিক্ষার বেলায় অবহেলা করি এটা তো ঈমানের দাবি হতে পারে না।
সত্যি কথা বলতে কী, কুরআন ও কুরআনের শিক্ষার প্রতি এই ঔদাসীন্যের কারণেই সমাজে শিক্ষিতের হার বাড়ছে ঠিক কিন্তু নীতিবান ও আদর্শ দেশ প্রেমিকের সংখ্যা বাড়ছে না। সমাজের প্রতি শাখায়, প্রতিটি পরিবারে শিক্ষিত সন্তানদের নিয়েও বিপদে দিন গুজরান করছেন অসহায় অভিভাবকরা। আল্লাহ মাফ করুন, আমরা অভিভাবকদের বুঝতে হবে কুরআনের প্রতি আমাদের অনাদরের কারণেই আমাদের ছেলেমেয়েরা মানুষ হচ্ছে না।
আমাদের সরকারের কাছে আবেদন, তারা যেন প্রতিটি শিশুর জন্য কুরআনের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। প্রতিটি শিশুকে কুরআনের আলোয় বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেন।
কুরআনের প্রতি যত্নবান হওয়া এবং কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণার আহ্বান
মুহতারাম হাযেরীন! আলহামদু লিল্লাহ। আমরা যারা কুরআন শিখেছি, যারা কুরআন পড়তে পারি, তাদের উচিত কুরআনের প্রতি যত্নবান হওয়া। মনোযোগসহ বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। বিনয় ও আদবের সাথে চিন্তা-গবেষণার মানসিকতা নিয়ে তিলাওয়াত করা। আপনারা নিশ্চয় জানেন কী বিপুল ছাওয়াব এই তিলাওয়াতে!
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব থেকে একটি আয়াত পড়বে, তার জন্য একটি নেকী লেখা হবে। আর নেকীটিকে করা হবে দশগুণ। আমি বলছি না الم একটি হরফ। বরং ‘আলিফ’ একটি হরফ, ‘লাম’ একটি হরফ এবং ‘মীম’ একটি হরফ’ (তিরমিযী)।
সুপ্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! আমাদের উচিত ভালোভাবে কুরআন শিক্ষা করা এবং বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। কেননা কুরআনে রয়েছে আলো, আরোগ্য, রহমত, সুবাস, হিদায়াত, আল্লাহর যিকির এবং তাঁর প্রমাণ। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে তাঁর পবিত্র কালাম বেশি বেশি পড়ার এবং তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ وَبَارِكْ عَلى مُحَمَّدٍ وَعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلى آلِ إِبْراهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ
হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যথাযথ হক আদায় করে কুরআন তিলাওয়াতের তাওফীক দান করুন। যথাযথ আদব রক্ষা করে আপনার পবিত্র বাণীসম্ভার তিলাওয়াত করার তাওফীক দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের ছেলে-সন্তানদেরকে সঠিকরূপে কুরআন শেখানোর তাওফীক দান করুন। কুরআনের আলোয় আমাদের সবাইকে আলোকিত করুন। আপনি আমাদেরকে বুঝে বুঝে কুরআন তিরাওয়াতের তাওফীক দিন। কুরআনের প্রতিটি নির্দেশ বাস্তবজীবনে প্রয়োগের তাওফীক দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের দেশ ও সমাজে কুরআনের আদর্শ কায়েম করে দিন। যারা কুরআন থেকে দূরে তাদেরকে কুরআনের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসুন। যারা কুরআনের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে তাদেরকে আপনি সুপথ দেখান, তাদেরকে হিদায়েত নসীব করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।
عبَادَ اللهِ رَحمِكُمُ الله : (إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ والإحْسَانِ وَإيْتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالمْنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنِ) اُذْكُرُوا اللهَ يَذْكُرْكُمْ وَادْعُوْهُ يَسْتجِبْ لَكُمْ وَلَذِكْرُ اللهِ تَعَالَى أَعْلَى وَأَعْظَمُ وَأَكْبَرُ.