اَلْحَمْدُ لِلَّهِ مُسَيَّرُ الْأَزْمَانِ، وَمُدَبِّرُ الْأَكْوَانِ، أَحْمَدُهُ سُبْحَانَهُ، يَسْأَلُهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِيْ شَأْنٍ، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، خَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيْراً، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدَاً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، بَعَثَهُ اللهُ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ بَشِيْراً وَنَذِيْراً، وَدَاعَياً إِلَى اللهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجاً مُنِيْراً، صَلَّى اللهُ وَسَلَّمَ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ وَأَتْبَاعِهِ، وَسَلَّمَ تَسْلِيْماً كَثِيْراً. أَمَّا بَعْدُ:
সুপ্রিয় হাযেরীন! বিদায় নিল স্মৃতি বিজড়িত বর্ণিল কতগুলো দিন। সমাপ্ত হলো একটি বছর। সূচনা হলো আরেকটি বছরের। একটি রাতের প্রান্তে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ আনন্দিত হয় একটি নতুন ভোর আসবে বলে। প্রভাতে নতুন এক সূর্য উদিত হবে বলে। কিন্তু আমার অনুভূতি একটু ব্যতিক্রম। বছর শেষে নতুন আরেকটি বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য আমি আনন্দ-উল্ল¬াস করতে পারি না। আমার অনুভূতি হলো, যে দিনগুলো শেষ হয়ে গেল তা তো আমার জীবনেরই একটি অংশ। কবি বলেন :
يَسُرُّ النَّاسَ مَا ذَهَبَ اللَّيَالِيْ * وَلَكِنَّ ذَهَابُهُنَّ لَهُ ذَهَابَا
‘দিবস-রজনীর আগমন-প্রস্থান মানুষকে আনন্দ দেয় অথচ চলে যাওয়া দিনগুলো যে তাদের নিজদেরই চলে যাওয়ার নামান্তর’।
একটি বছর শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমাদের জীবন নামক প্রাসাদ থেকে ৩৬৫ দিনের ৩৬৫ টি পাথর খসে পড়ল। ৩৬৫ দিন ছোট হয়ে গেল আমাদের জীবন। আমাদের জন্য এটা অবশ্যই কোনো শুভ সংবাদ নয়। নয় কোনো আনন্দের সংবাদ। বরং এটি আমাদের চিন্তার কারণ, উৎকণ্ঠার কারণ। বিগত বছরটি কিভাবে কাটিয়েছি? আগামী বছর কিভাবে কাটাব? গত বছর আমাদের অর্জন কি কি? এ জাতীয় আরো কত প্রশ্ন আমাদের চেতনাকে নাড়া দিচ্ছে।
প্রিয় মুসলিম ভাই! আমি আপনাদেরকে গত বছরের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ভর্ৎসনা করার লক্ষ্যে সম্বোধন করছি না। বিগত দিনগুলো আপনাদের বেহুদা কেটেছে একথাও আমি বলছি না। বরং আমি বলতে চাচ্ছি যে আসুন আমরা সবাই জীবনকে অন্যভাবে দেখি, যেখানে থাকবে সুউচ্চ প্রত্যাশা, নিরলস আমল এবং নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা।
প্রিয় ভাইয়েরা! আমরা হয়ত গত বছর অনেক পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু তার বেশির ভাগ অথবা কোনো একটিও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ফলে হয়ত আমরা মনোযাতনায় ভুগছি। উন্নতি-অগ্রগতির পথে দ্বিতীয়বার চলতে কুণ্ঠাবোধ করছি। হ্যাঁ, আত্মসমালোচনা অবশ্যই জরুরী। আলবৎ দরকার অতীতের হিসাব-নিকাশ মিলানো। তবে তা যেন উদ্দীপনা, উৎসাহ ও আগ্রহে ব্যত্যয় না ঘটায় সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। শয়তান যেন নিরাশার অন্ধগলিতে আমাদের পৌঁছে না দেয় সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর রহমত ও করুণা থেকে কখনো নিরাশ হয় না, হতে পারে না। ইরশাদ হয়েছে :
{ قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ }
‘বল, ‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা আয-যুমার:৫৩)।
তাই আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে এগিয়ে যেতে হবে সম্মুখপানে। কখনও একথা বলা যাবে না যে, আমি কোনো কাজ নিয়মিতভাবে করে যেতে পারি না, অথবা কোনো কাজ পূর্ণরূপে সম্পাদন করতে পারি না। আমি আমার নিজের সম্পর্কে ভাল জানি, আমি ছোট বেলা থেকে এ ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। অতএব, এটি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এরূপ কখনো বলা যাবে না। বরং বলতে হবে, গেল বছরের ব্যর্থতা আমার প্রতিভা বিকাশের প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। ত্রুটিগুলো এড়িয়ে যেতে সাহায্য করবে। আমি অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করব। একবার না পারলে শতবার চেষ্টা করে দেখব। আল্লাহ তাআলা অবশ্যই চেষ্টাকারীদের চেষ্টা বিনষ্ট করেন না। আমলকারীদের আমল বিফল করে দেন না। তাই আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে বলতে হবে যে আমি এ কাজ অবশ্যই সম্পন্ন করতে পারব। আমরা যদি এ ধরনের প্রত্যয়ী মনোভাব পোষণ করি এবং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল-ভরসাকে সঙ্গী বানিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণবহ কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়তে সক্ষম হই, তবে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই আমাদেরকে দুনিয়া-আখিরাতের কামিয়ামীতে ভূষিত করবেন। আমরা আমাদের চেষ্টা সাধনায় ব্যর্থকাম হব না।
প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! আমাদের উচিত সফলতা অর্জনের জন্য দৃঢ়প্রত্যয়ী হওয়া। লৌহকঠিন মানসিকতা পোষণ করা। মনে রাখবেন, উন্নতির প্রথম পদক্ষেপ হলো সত্যিকার আগ্রহ ও সুদৃঢ় প্রত্যয়। আর সাথে থাকবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ও দু‘আ। জনৈক মনীষী যথার্থই বলেছেন : ‘যখন তোমার কাছে সফলতা অর্জনের প্রজ্জ্বলিত আগ্রহ থাকবে তখন কেউ তোমাকে থামাতে পারবে না’। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
( وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلَا تَعْجَزْ، وَإِنْ أَصَابَكَ شَيْءٌ فَلَا تَقُلْ: لَوْ أَنِّي فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا، وَلَكِنْ قُلْ: قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ، فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ )
‘ তুমি আল্লাহর নিকট সাহায্য চাও, অপারগতা প্রকাশ করো না, একথা বলো না যে, যদি আমি এমন এমন করতাম তাহলে এমন এমন হত। বরং বল, আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করেন। কেননা ‘যদি’ শয়তানের কাজকে উন্মুক্ত করে দেয়’ (মুসলিম)।
মজবুত আগ্রহ ও দৃঢ় প্রত্যয় থাকলে আপনার আমার সকল পরিকল্পনা আল্লাহ চাহে তো বাস্তবায়ন হতে বাধ্য। তাই সকল সংশয় সন্দেহ দূরে রেখে আমাদেরকে প্রত্যয়ী হতে হবে। জনৈক কবি বলেন :
إِذَا كُنْتَ ذَا رَأْيٍ فَكُنْ ذَا عَزِيْمَةٍ *فَإِنَّ فَسَادَ الْرَّأْيِ أَنْ تَتَرَدَّدَ
‘যদি তুমি সুন্দর অভিমত প্রকাশ করতে পার, তাহলে তুমি দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী হও। কেননা সংকল্প নষ্ট হয়ে যায় সংশয়ের কারণে’।
প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দিয়েছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর। তিনি আমাদের দিয়েছেন বিবেক ও বুদ্ধি। করেছেন আমাদেরকে সম্মানিত। অতএব আমাদের জীবনের উত্তম আশা-আকাক্সক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে কখনো অপারগতা প্রকাশ করা উচিত হবে না। কবির ভাষায় :
وَلَمْ أَرَ فِيْ عُيُوْبِ النَّاسِ عَيْباً * كَعَجْزِ الْقَادِرِيْنَ عَلَىَ التَّمَامِ
‘মানুষের দোষ-ত্রুটির মাঝে এমন কোনো দোষ আমি দেখিনি যা সামর্থ্যবান ব্যক্তির অপারগতা প্রকাশ থেকে প্রকট হবে’।
সুপ্রিয় মুসল্লিয়ান! আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল ও ভরসার পর আমাদের ইচ্ছাগুলো বাস্তবায়নের জন্য যা করতে হবে তা হলো, সুষ্ঠু ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ। কেননা পরিকল্পিত জীবনই সফল জীবন। যে ব্যক্তির জীবনাধ্যায়গুলো সুষ্ঠু পরিকল্পনায় সুবিন্যস্ত নয় সে কি দুনিয়া কি আখিরাত কোনো ক্ষেত্রেই বড় ধরনের সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয় না। সে হিসেবে আমাদের পুরো জীবনটাকেই সুস্পষ্ট পরিকল্পনার বলয়ে বেঁধে নিতে হবে। আমি যদি ষাট বছর বাঁচি, তাহলে আজ থেকে ষাট বছর পর আমি নিজেকে দীন ও দুনিয়া উভয় ক্ষেত্রে কোন্ অবস্থানে দেখতে চাই। দীন চর্চায়, আল্লাহর ইবাদত চর্চায়, দীনের খেদমত ও সামগ্রিক বাস্তবায়নে আমি নিজকে কোন অবস্থানে দেখতে চাই। এসব ক্ষেত্রে আমি কি নিজেকে শীর্ষাবস্থানে দেখতে চাই? আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কাতারে দেখতে চাই? না কি চাই না। তদ্রুপভাবে হালাল রিযক উপার্জানের ক্ষেত্রে নিজকে কোনো অবস্থানে দেখতে চাই। এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করে সে অনুযায়ী আমাদের জীবনের প্রতিটি বছর, মাস ও দিনকে সুবিন্যস্ত করতে হবে। যেমন ধরুন আপনি কুরআনুল কারীম হিফয করবেন বলে মনস্থির করেছেন। আজ থেকে দশবছর পর আপনি নিজেকে হাফেযে কোরআন হিসেবে দেখতে চান। তাহলে আপনি এ মর্মে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা হাতে নিন। খাতায় তা লিপিবদ্ধ করুন। আল কুরআনের মোট আয়াত সংখ্যা হলো ৬২৩৬ আর দশ বছরে দিন সংখ্যা হলো ৩৬৫ সে হিসেবে প্রতি বছর আপনাকে কয়টি আয়াত মুখস্ত করতে হবে, প্রতি মাসে কয়টি করে আয়াত মুখস্ত করতে হবে, প্রতি সপ্তাহে কয়টি করে আয়াত মুখস্ত করতে হবে এবং প্রতিদিন কয়টি করে আয়াত মুখস্ত করতে হবে তা সুস্পষ্টভাবে লিখে কাজে লেগে যান দেখবেন দশ বছর পর আপনি কুরআনের হাফেয হয়ে গেছেন।
এভাবে আপনার জীবনের বড় বড় লক্ষগুলো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করে লিখে নিন। প্রতিটি কাজ শেষ করার ডেডলাইন নির্ধারণ করুন। আপনার লক্ষ্যে পৌঁছতে বছরে, মাসে, সপ্তাহে ও দিনে কতটুকু সময় ব্যয় করতে হবে তা নির্ণয় করে কঠিনভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করুন। প্রতিটি মিনিট নিয়ন্ত্রণ করুন। কাজে লেগে যান। দেখবেন আল্লাহ আপনাকে সফলতার শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন।
بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآن الْعَظِيْمِ وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْر الحْكِيْمِ, أقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ فَاسْتَغْفِرُوهُ إِنَّهُ هُو الْغَفُور الرَّحِيْمْ .
اَلْحَمْدُ لِلَّهِ عَظِيْمِ الْإِحْسَانِ، وَاسِعِ الْفَضْلِ وَالْجُوْدِ وَالْامْتِنَانِ، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، صَلَّىَ اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ أَجْمَعِيْنَ وَسَلَّمَ تَسْلِيْماً كَثِيْراً، أَمَّا بَعْدُ :
মুহতারাম মুসল্লিয়ান! সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়। দিন-সপ্তাহ-মাস-বছর দেখতে না দেখতেই ফুরিয়ে যায়। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সফলতা-ব্যর্থতা সবকিছু বক্ষে ধারণ করে মানুষের জীবন থেকে বিদায় হতে থাকে বছরের পর বছর। আর এভাবে বিদায় হতে হতে একদিন দেখা যাবে আপনার আমার জন্য বরাদ্দকৃত সময়ের পুরোটাই নিঃশেষিত হয়ে আমাদেরকে পৌঁছে দেবে মৃত্যুর ঠিকানায়। তুলে দেবে মালাকুল মাওতের হাতে। সে হিসেবে কারো জীবন থেকে একটি দিন চলে যাওয়ার অর্থ পরজীবনের দিকে একদিন এগিয়ে যাওয়া। তাই যারা বুদ্ধিমান তাদের কাজ হবে আগত জীবনের জন্য বর্তমান জীবনের প্রতিটি ক্ষণ ব্যবহার করা। প্রতিটি মূহূর্ত কাজে লাগানো। আর সৌভাগ্যবান তো সে যে দীর্ঘজীবন পেল এবং তাকে নেক আমলে কানায় কানায় ভরে তুলল। পক্ষান্তরে হতভাগ্য তো সে, যে দীর্ঘজীবন পেল ঠিকই কিন্তু নেক আমল থেকে দূরে রইল। নেক আমলের অধিকারী হতে ব্যর্থ হলো।
আমরা একটি বছর পেছনে ফেলে আরেকটিকে সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। জানি না কার কার ভাগ্যে আগত এ বছরটি অতিক্রম করা সম্ভব হবে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত হবে নিজ নিজ জীবনের হিসাব-নিকাশ নিয়ে বসা। গেল বছরটি যদি পোক্ত ঈমান, সুন্দর আমল, সততা-সত্যবাদিতা, ইখলাস-ঐকান্তিকতা ইত্যাদির মাধ্যমে অতিবাহিত হয়ে থাকে তবে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া করা এবং আগামী বছরটি একইরূপে ভালোয়-ভালোয় যাতে কেটে যায় তার জন্য প্রত্যাশা, দু‘আ ও প্রতিজ্ঞা করা প্রয়োজন। আর যদি গেল বছরটি মন্দভাবে কেটে থাকে, গুনাহ ও পাপাচারের অন্ধকারময়তায় কেটে থাকে, তবে অনুতাপ, অনুশোচনা, তাওবা এবং নবউদ্দীপনায় উজ্জীবিত হয়ে সম্পুখপানে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়-প্রেরণা পোষণ করা আবশ্যক। মাইমুন ইবনে মাহরান বলেছেন : ‘তাওবাকারী অথবা যে ব্যক্তি নেক আমল করে স্বীয় মর্যাদাবৃদ্ধির মুজাহাদায় লিপ্ত, এ দু’ব্যক্তি ছাড়া বাকিরা সবাই ধ্বংসে নিপতিত। আল্লাহ তাআলা বলেন :
{ وَالْعَصْرِ. إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ. إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ. }
‘ সময়ের কসম, নিশ্চয় আজ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ততায় নিপতিত। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে’ (সূরা আল আসর)।
এখানে আল্লাহ তাআলা আসর তথা কালের কসম খেয়েছেন। যে কালে যাপন করছে প্রতিটি মানুষ তার জীবন। আল্লাহ তাআলা কসম খেয়ে বলছেন যে প্রতিটি মানুষই নিপতিত রয়েছে ধ্বংসে তবে যারা চারটি গুণে গুণান্বিত কেবল তারা ছাড়া- (১) ঈমান (২) নেক আমল (৩) পরস্পরে সত্যের উপদেশ (৪) পরস্পরকে ধৈর্য ও সবরের উপদেশ।
আল কুরআনের ছোট্ট এ সূরাটি একজন মুমিনের জন্য তার আমল মেপে দেখার দাঁড়িপাল্লা স্বরূপ, যা ব্যবহার করে সে নিজের লাভ-ক্ষতির হিসাব মিলাতে পারে। এ জন্যই ইমাম শাফেয়ী রহ বলেছেন, ‘সকল মানুষ যদি এ সূরাটি অনুধাবন করত, তবে তাদের জন্য যথেষ্ট হত’। সালাফে সালেহীনদের কেউ বলেছেন, ‘আজকের দিনটা গতকালের মতো হলে সিদ্দিকীন তথা সত্যাশ্রয়ীরা আল্লাহকে লজ্জা পেতেন’। অর্থাৎ তাদের আজকের আমল যদি গতকালের আমলের চেয়ে অধিক না হত, আরো উত্তম না হত তবে তারা আল্লাহর কাছে লজ্জা অনুভব করতেন। তার অর্থ একজন সত্যিকার মুমিনের হৃদয়ের গভীরে এ বাসনা সদা জাগ্রত থাকে যে, আমার বর্তমান ঈমান ও আমল অতীতের চেয়ে উত্তম হবে। মুমিনের এ বাসনা তার নেক আমলের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করে তোলে। সে বিবেচনায় মুমিনের দীর্ঘজীবন মুমিনের কল্যাণের পাল্লা ভারি করার সুযোগ এনে দেয়। দীর্ঘজীবন মুমিনকে দেয় ছাওয়াব ও কল্যাণে আরো উচ্চতা, আরো শীর্ষতা। এ ক্ষেত্রে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি দু‘আ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন :
( وَاجْعَلِ الْحَيَاةَ زِيَادَةً لِي فِي كُلِّ خَيْرٍ، وَالْمَوْتَ رَاحَةً لِي مِنْ كُلِّ شَرٍّ )
‘হে আল্লাহ! আপনি আমার জীবনকে সকল কল্যাণে বাড়িয়ে দিন, আর মৃত্যুকে করুন প্রত্যেক অকল্যাণ থেকে নি®কৃতির মাধ্যম‘ (তাবারানী, সহীহ)।
কথিত আছে- মৃতব্যক্তিদের একজনকে স্বপ্নে দেখা হলো। অতঃপর মৃত ব্যক্তি বলল : ‘আমাদের কাছে লজ্জিত হওয়ার চেয়ে অধিক আর কিছু নেই। আর তোমাদের কাছে গাফলত-উদাসীনতার চেয়ে অধিক আর কিছু নেই’। অপর একজন মৃতব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখা হলো। সে বলল : আমরা একটি বিশাল ব্যাপারে লজ্জিত হয়েছি। আর তা হলো, আমরা জানি কিন্তু আমলের সুযোগ নেই, আর তোমরা আমল কর কিন্তু জান না। আল্লাহর কসম! আমাদের কারও আমলনামায় একটি বা দু’টি তাসবীহ, এক রাকাআত বা দু’রাক‘আত নামায দুনিয়া এবং দুনিয়ায় যা আছে তার চেয়ে অধিক প্রিয়’।
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! কথায় আছে, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। তাই জীবনের যে দিনগুলো আমাদের হাতে রয়েছে তা যদি নেক আমল দিয়ে ভরে দিতে পারি, পরিশুদ্ধ ঈমানের উত্তাপ নিয়ে কাটাতে পারি তবে আশা করা যায় আল্লাহ তাআলা আমাদের বিগত জীবনের ত্র“টি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেবেন। আর যদি বাকি দিনগুলো গোমরাহীতে কাটাই তবে অতীতে যা করেছি তাও গেল, আর ভবিষ্যত তো থাকবে অন্ধকারেই নিমজ্জিত।
প্রিয় ভাইয়েরা! দুনিয়ার আরাম-আয়েশ বড়ই ক্ষণস্থায়ী। দুনিয়ার বিত্তবৈভব মাত্র কয়েকদিনের। ইরশাদ হয়েছে :
{ أَفَرَأَيْتَ إِنْ مَتَّعْنَاهُمْ سِنِينَ. ثُمَّ جَاءَهُمْ مَا كَانُوا يُوعَدُونَ. مَا أَغْنَى عَنْهُمْ مَا كَانُوا يُمَتَّعُونَ }
‘ তুমি কি লক্ষ্য করেছ, আমি যদি তাদেরকে দীর্ঘকাল ভোগ-বিলাসের সুযোগ দিতাম। অতঃপর তাদেরকে যে বিষয়ে ওয়াদা করা হয়েছে, তা তাদের নিকট এসে পড়ত, তখন যা তাদের ভোগ-বিলাসের জন্য দেয়া হয়েছিল, তা তাদের কোনই কাজে আসত না। (আশ-শুআরা : ২০৫-২০৬)।
আর মনে রাখবেন, যাকে আল্লাহ দীর্ঘজীবন দান করলেন, তার কিন্তু ওজর পেশের সকল দরজাও বন্ধ করে দিলেন। সহীহ বুখারীর এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
( أَعْذَرَ اللَّهُ إِلَى امْرِئٍ أَخَّرَ أَجَلَهُ حَتَّى بَلَّغَهُ سِتِّينَ سَنَةً )
‘ আল্লাহ যাকে ষাট বছর বয়স দিলেন তিনি তার ওজর কর্তন করে দিলেন’ (বুখারী)।
সুনানে তিরমিযীর এক হাদীসে এসেছে : ‘আমার উম্মতের বয়স ষাট থেকে সত্তর বছরের মাঝে’। তাই আমরা সবাই সর্তক হয়ে যাই। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে, প্রতিটি ক্ষণকে আল্লাহ তাআলার রেযামন্দী অন্বেষণে ব্যয় করি। নববর্ষের আগমণে খুশি না হয়ে অতীতের হিসাব নিয়ে বসি। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে বসি।
সুপ্রিয় মুসল্লিয়ান! অনেক দীর্ঘজীবন পেয়েও যারা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে সময় কাটায়, পাপ-গুনাহে নিমজ্জিত হয়ে সময় কাটায়, আরাম-আয়েশ ও উদাসীনতায় সময় কাটায়, এমন লোকদেরকে জাহান্নামের আগুনের ছেকা দিয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি কি দুনিয়ার কোনো কিছু পেয়েছিলে? দুনিয়ার কোনো নিয়ামত ভোগ করেছিলে? সে বলবে, ‘না, হে আমার রব!’ জাহান্নামের আগুনের প্রথম ছেকাতেই সে দুনিয়ার সকল নেয়ামত ভুলে যাবে। এটা হলো তাদের অবস্থা যারা দীর্ঘজীবন পেয়েছে কিন্তু তা খেল-তামাশায় অতিবাহিত করেছে। গাফলতে অতিবাহিত করেছে। তাদেরকে অঢেল সম্পদ দেয়া হয়েছিল কিন্তু তারা তা হারাম জায়গায় অবৈধ কর্মে ব্যয় করেছে। তারা প্রবৃত্তির তাড়নার পেছনে ছুটেছে অবিরত। পরিত্যাগ করেছে দীনের বিধান। লঙ্ঘন করেছে আল্লাহর সীমানা। পরিশেষে পরকালে হাজির হয়েছে শূন্য হাতে। আর সেখানে লজ্জিত হয়েছে দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের জন্য। ইরশাদ হয়েছে :
{وَجِيءَ يَوْمَئِذٍ بِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ يَتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ وَأَنَّى لَهُ الذِّكْرَى. يَقُولُ يَا لَيْتَنِي قَدَّمْتُ لِحَيَاتِي. فَيَوْمَئِذٍ لَا يُعَذِّبُ عَذَابَهُ أَحَدٌ }
‘ আর সেদিন জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে, সেদিন মানুষ স্মরণ করবে কিন্তু সেই স্মরণ তার কী উপকারে আসবে? সে বলবে, ‘হায়! যদি আমি আগে কিছু পাঠাতাম আমার এ জীবনের জন্য’! অতঃপর সেদিন তাঁর আযাবের মত আযাব কেউ দিতে পারবে না’ (সূরা আল ফজর : ২৩-২৫)
তাই ভাইয়েরা আমার! সতর্ক হোন, সচেতন হোন। নতুন বছরে ঈমান ও আমলে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলুন। কেননা এ দুনিয়ার আরাম আয়েশ ক্ষণস্থায়ী। পরকালই হলো আসল জীবন। তাই পরকালের জন্য প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগান। ইরশাদ হয়েছে :
{ إِنَّمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَإِنَّ الْآَخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ . مَنْ عَمِلَ سَيِّئَةً فَلَا يُجْزَى إِلَّا مِثْلَهَا وَمَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ يُرْزَقُونَ فِيهَا بِغَيْرِ حِسَابٍ }
‘ এ দুনিয়ার জীবন কেবল ক্ষণকালের ভোগ আর নিশ্চয় আখিরাতই হল স্থায়ী আবাস’। কেউ পাপ কাজ করলে তাকে শুধু পাপের সমান প্রতিদান দেয়া হবে আর যে পুরুষ অথবা নারী মুমিন হয়ে সৎকাজ করবে, তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, সেখানে তাদেরকে অগণিত রিয্ক দেয়া হবে’ (সূরা আল গাফের : ৩৯-৪০)।
اللّهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ وَبَارَكْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْم إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنِ الْخُلَفَاءِ الْرَّاشِدِيْنَ وَعَنِ الْصَّحَابَةِ أَجْمَعِيْنَ وَعَنِ الْتَّابِعِيْنَ وَمَنْ تَبِعَهُمْ بِإِحْسَانٍ إِلَى يَوْمِ الْدِّيْنَ وَعَنَّا مَعَهُمْ بِمَنِّكَ وَكَرَمِكَ وَعَفْوِكَ وَإِحْسَانِكَ يَا أَرْحَمَ الْرَّاحِمِيْنَ.
হে আল্লাহ! আমরা একটি বছর শেষ করে আরেকটি বছর শুরু করতে যাচ্ছি। রাব্বুল আলামীন! বিগত বছরে আমাদের দ্বারা অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি হয়েছে, গাফলত ও উদাসীনতায় কেটে গেছে অনেক সময়, অনেক দিবস-রজনী। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিন। নতুন উদ্যোগে নতুন বছর শুরু করার তাওফীক দিন। ঈমান, আমল, তাকওয়া ও পরহেযগারীতে সমৃদ্ধ হয়ে লৌহকঠিন ইচ্ছা নিয়ে নতুন বছর শুরু করার তাওফীক দিন। হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, হারাকাত-সাকানাত যেন আপনার রেযামন্দী অনুযায়ী হয় সে তাওফীক আমাদের দান করুন। হে আল্লাহ! আমরা যেন পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতে পারি সে তাওফীক দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।
عبَادَ اللهِ رَحمِكُمُ الله : (إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ والإحْسَانِ وَإيْتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالمْنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنِ ) اُذْكُرُوا اللهَ يَذْكُرْكُمْ وَادْعُوْهُ يَسْتجِبْ لَكُمْ وَلَذِكْرُ اللهِ تَعَالَى أَعْلَى وَأَعْظَمُ وَأَكْبَرُ.